জুনাইদের গল্পটা !!!!

মো. জুনাইদের কাছে ‘মা’ ও ‘বাবা’ সবচেয়ে কঠিন দুই শব্দ। তাঁর বয়স যে ঠিক কত, তা আমরা জানি না, জুনাইদ নিজেও জানেন না। না-জানা বয়সী এ জীবনে কখনো কাউকে মা-বাবা বলে ডাকার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন কক্সবাজারের ঝাউতলায়। জুনাইদকে হয়তো পথেই পেয়েছিলেন নাজিরাটেকের নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ সাহারা খাতুন। শুঁটকির আড়তে কাজ করতেন তিনি, শীতকালে পিঠা বেচতেন। জুনাইদের বয়স যখন পাঁচ-ছয়, তখন সাহারাও চিরবিদায় নিলেন। যার হারানোর কিছুই ছিল না, সে–ও একদিন একজনকে হারিয়ে ফেলল! সঙ্গে হারাল মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুও। জুনাইদ ফিরে গেল তাঁর পুরোনো ঠিকানায়—পথে। সাহারা খাতুনকে নানি ডাকত জুনাইদ। তাঁর আশ্রয়ে থাকার সময় লাকড়ি জোগাড় করা, শুঁটকি শুকানোর মতো কাজ করেছিল সে। পথে নেমে শুরু করল কাগজ টোকাতে। ঘুমাত খোলা আকাশের নিচে—মাটিতে। কপাল খুব ভালো থাকলে কোনো ছাউনির নিচে—মেঝেতে। খাবার বলতে ছিল উচ্ছিষ্ট। বিশেষ করে সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যাওয়া মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার। এভাবে বছর দু-এক কেটে গেলে জুনাইদ একটি চায়ের দোকানে কাজ পেল। ছোট্ট জীবনে সেটিই ছিল বড় প্রাপ্তি। কারণ, চালচুলো নেই বললেই লোকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কাজ দিলে সব নিয়ে যদি ভেগে যায়, তখন কোথায় পাবে তাকে। তবে জুনাইদ সাড়ে তিন বছরে একাধিক দোকানে কাজ করল নিষ্ঠার সঙ্গে। কারও কাছে হাত পাতল না, কারও কিছু চুরিও করল না। তারপরও মানুষ তাঁকে উঠতে-বসতে গালাগাল দিত কিংবা মারপিট করত! জুনাইদ ভেবেছিল, এটাই বুঝি নিয়ম। সমুদ্র ও সিনেমা ওই নিয়মে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারছিল না জুনাইদ। ২০১০-১১ সালে গেল টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে। এক জেলে পরিবারের সঙ্গে চুক্তি হলো। সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে, মাছ ধরার কাজ না থাকলে পাহাড় থেকে লাকড়ি এনে দেবে; বিনিময়ে থাকা-খাওয়া। খুশি মনে রাজি হলো সে। রাত জেগে নৌকা বেয়ে যায় সমুদ্রে, জাল পেতে মাছ ধরে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ে যায়, লাকড়ি জোগাড় করে এনে হাটে বেচে টাকা বুঝিয়ে দেয়। আর সুযোগ পেলেই বাজারের চায়ের দোকানের বাঁশের বেড়ার ফুটোয় চোখ রাখে। সিনেমা দেখার বেজায় নেশা ধরে গেছে তত দিনে। বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি—সব সিনেমাই গোগ্রাসে গেলে সে। তবে নিয়ম হলো, পয়সা দিয়ে চা-নাশতা খেতে বসলেই কেবল সিনেমার অদৃশ্য টিকিট মিলবে। তাই দোকানিরা বেড়ার ফুটোতে চোখ দেখলেই ‘পানি মারতেন’, ধাওয়া করতেন। এত কিছুর মধ্যেও আমির খানের থ্রি ইডিয়টস দেখে ফেলল জুনাইদ। তাঁর কথায়, ‘এই সিনেমাটা দেখে পড়াশোনার খুব আগ্রহ হলো। আর কক্সবাজারের বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হতো, ইশ্, আমিও যদি পড়তে পারতাম! মনে হতো, কেউ যদি বলত, তুই সারা দিন টয়লেট পরিষ্কার করার বিনিময়ে স্কুলে পড়তে পারবি, তার পরও আমি তা-ই করব।’ ওই ইচ্ছের সলতেটা আরও উসকে দিয়ে গেল সমুদ্রের এক বন্ধু, যার নাম জুবায়ের। বয়সে সে জুনাইদের ছোটই ছিল, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বিরতি নিয়েছিল। সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত জুনাইদের মতোই। হঠাৎ একদিন সে বলল, আর মাছ ধরতে আসবে না, আবার স্কুলে যাবে। জুনাইদ বলল, ‘আমিও তো স্কুলে যাইতে চাই। তুই একটা ব্যবস্থা করবি আমার জন্য?’ জুবায়ের দিল জাহাঙ্গীর স্যারের ঠিকানা। বলল, ‘জাহাঙ্গীর স্যার ভালো মানুষ। তাঁর কাছে গিয়া বুঝায়া বললে ব্যবস্থা হবে।’ মৌসুনী দ্বীপে জাহাঙ্গীর স্যার ঠিকই ব্যবস্থা করলেন। যে ছেলের বর্ণপরিচয় নেই, তার ওপর আস্থা রাখলেন। নুরুল আমিন নামের আরেক ছাত্রের কাছে পাঠালেন জুনাইদকে। এর মধ্যে জুনাইদ অনেক কষ্টে জমানো ১০ টাকা দিয়ে কিনল ‘বাংলা শিক্ষা’ ও ‘মাই স্পেলিং বুক’। বই কেনার তারিখটাও ঠিক মনে রেখেছেন জুনাইদ—২০১১ সালের ৭ অক্টোবর! সে সময় রাত জেগে মাছ ধরতেন, সুযোগ পেলেই কুপির আলোতে নৌকায় খুলে বসতেন বই দুটি। দিনেও ঘুমাতেন না, বই খুলে বসতেন। জুনাইদ বলছিলেন, ‘কেউ বিশ্বাস করে না, কিন্তু আমি ১০ দিনে দুটি বই-ই পড়ে শেষ করলাম। এক শটার মতো ইংরেজি শব্দও শিখে ফেললাম। আর মাঝেমধ্যে জাহাঙ্গীর স্যার যেখানে প্রাইভেট পড়াতেন সেখানে যেতাম। পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই ৪৫ ডিগ্রি কোণ আঁকাও শিখে ফেললাম। তারপর একদিন স্যারকে বললাম, স্যার, আমিও পরীক্ষা দেব। স্যার রাজি হলেন। প্রাইভেটের ওই পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হলাম।’ জাহাঙ্গীর স্যার বিস্মিত হয়েছিলেন কি না, জানা নেই। হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তাই হয়তো তিনি জুনাইদকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ওই জেলে পরিবার ভীষণ বেঁকে বসল। জুনাইদ নৌকায় একটা পড়ার টেবিলের মতো বানিয়ে নিয়েছিলেন, সেটাও লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিল। বলল, ‘শখ কত!’ লোকে হাসাহাসি করতে লাগল। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল, ‘পড়াশোনা করে তুই কী হবি?’ কিশোর জুনাইদ বলল, ‘ইঞ্জিনিয়ার হব।’ ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মাছ ধরার কাজে বিরতি দিল জুনাইদ। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে জোগাড় করল ১ হাজার ৬০০ টাকা। ওই টাকা, জাহাঙ্গীর স্যারের সুপারিশ আর বুকভরা সাহস নিয়ে সে গেল টেকনাফের মৌসুনী দ্বীপের ল্যাদা জুনিয়র হাইস্কুলে। অনেক অনুনয়ের পর, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুনাইদ এক লাফে ভর্তি হলো অষ্টম শ্রেণিতে। নিজের টাকায় বই, স্কুলের পোশাক কিনল। কিন্তু খেয়ে-পরে বাঁচতে তো হবে। তাই আবারও গেল মাছ ধরতে। সারা রাত মাছ ধরে কোনোরকমে স্কুল ড্রেস পরে, বই-খাতা বগলদাবা করে ছুটে যেতে লাগল স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে। আর বাকি ছাত্রছাত্রীরাও তাকে দেখে জায়গা করে দিতে লাগল তড়িৎগতিতে। জুনাইদ বলছিলেন, ‘গোসল না করেই স্কুলে যেতাম আমি, ফলে শরীরে মাছের ভয়ানক গন্ধ লেগে থাকত। সে কারণেই ওরা জায়গা করে দিত।’ এই করে করেই জুনাইদ একদিন জেএসসি পরীক্ষায় পেলেন জিপিএ-৫! দ্বিতীয় জীবন নবম শ্রেণিতে পা রাখার আগে ইটভাটায় কাজ নিল জুনাইদ। কাঠমিস্ত্রির কাজও করল। তিন হাজার টাকা জোগাড় হওয়ার পর গেল টেকনাফের হ্নীলা হাইস্কুলে। ভর্তি হল সেখানে। প্রধান শিক্ষক তাঁর ভাইয়ের বাসায় জায়গির হিসেবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ছোট দুটি শিশুকে পড়াতে হতো। কিন্তু ছয় মাসের বেশি সেখানে টেকা গেল না। এসএসসি পরীক্ষার আগ দিয়ে স্কুলেরই হোস্টেলে ওঠার সুযোগ হলো। কিন্তু সকালে নৌকা থেকে ফিরে সময়মতো অ্যাসেম্বলি ধরতে না পারায় শিক্ষকেরা চেপে ধরলেন, ‘সমস্যা কী তোর? হোস্টেলে থেকেও স্কুলে আসতে দেরি কেন?’ জুনাইদ তত দিনেও শিক্ষকদের কাছে তার মা-বাবার কথা বলেনি। একই কাজ সে করেছিল আগের স্কুলেও। কারণ, মা-বাবার পরিচয় নেই, এমন কোনো ছেলেকে কেউ সুনজরে দেখে না। জুনাইদ বাধ্য হলো সব খুলে বলতে। এবং তার পর থেকে কোনো কোনো শিক্ষক সুযোগ পেলেই তাকে বিষয়টি মনে করিয়ে দিতেন! তবে জুনাইদের কথা, ‘ভালো শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা না থাকলে তো আমি এতটুকু পথ আসতে পারতাম না। স্কুলের বেতন, পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি—সবই তাঁরা দিয়েছেন। এভাবেই আমি এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.৮৩ পেলাম।’ এরপর জুনাইদ ভর্তি হন উখিয়া ডিগ্রি কলেজে। কলেজে পড়ার টাকা জোগাড় করতে শুরু করলেন রাজমিস্ত্রির কাজ। ফলে ক্লাস শুরু হওয়ার এক মাস পর কলেজে যাওয়ার সুযোগ হলো। আবারও জায়গির থাকলেন। কলেজ বেতন মওকুফ করে দিল। টিউশন শুরু করলেন। নিজে কিন্তু কখনো কারও কাছে প্রাইভেট পড়েননি। তারপর একদিন বন্ধুদের মেসে উঠলেন জুনাইদ। থাকা-খাওয়া ফ্রি, শুধু বন্ধুদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে হতো। তারিখটা ঠিক মনে রেখেছেন জুনাইদ—২০১৭ সালের ৩০ মার্চ। দুদিন পর এইচএসসি পরীক্ষা। ঠিক করলেন, স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আসবেন। উঠে বসলেন অটোরিকশায়। খানিক বাদেই ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন চার যাত্রীর দুজন। জুনাইদের অবস্থাও সাংঘাতিক। পেট ফুঁড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেরিয়ে গেছে। চোখ আর মাথায় কঠিন আঘাত। শরীরের অধিকাংশ হাড়ই ভেঙে গেছে। বন্ধুরা ছুটে এলেন। অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পথে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, জুনাইদ আর নেই, হৃদ্যন্ত্র থেমে গেছে। উখিয়ায় ফিরে আসছিল অ্যাম্বুলেন্সটি। কিছু দূর যাওয়ার পর জুনাইদের হৃৎপিণ্ড জানান দিল, এখনো থামিনি! মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেন জুনাইদ। পরীক্ষা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। প্রায় এক বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল ও কুতুপালংয়ের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার পর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলেন তিনি। মাঝে তো শুনেছিলেন, জীবনে আর চোখ মেলে তাকাতে পারবেন না, পা দুটিও চলবে না। জুনাইদের ভাষায়, ‘বন্ধুবান্ধব, কলেজের শিক্ষকেরা না থাকলে কী হতো, জানি না! অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসেছি আমি। হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণের জন্যই ওপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ জুনাইদের স্বপ্ন এক বছর পর, ২০১৮ সালে আবার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে বসেন জুনাইদ। তাঁর ভাষায়, ‘যে সময় সবাই মা-বাবার আদরে পড়াশোনা করে, সে সময় আমি অসুস্থ শরীরে ইট ভেঙে খাবার জোগাড় করেছি, ভাঙা পা ড্রেসিং করে পরীক্ষা দিয়েছি।’ এত কিছু করে জুনাইদ এইচএসসিতে জিপিএ-৪.৫০ পেয়েছেন। বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের সহযোগিতায় পরীক্ষা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুযোগ পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শেষমেশ বেছে নিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিষয়টি। ফোনের ওপাশে কাঁদছিলেন জুনাইদ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার জীবনের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি কী?’ জুনাইদ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, ‘অ্যাকসিডেন্টের পর যেদিন চোখ মেলে তাকাতে পারলাম, সে স্মৃতিটা খুব আনন্দের। আর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পাওয়ার স্মৃতিটাও। ওই যে ছোটবেলায় সমুদ্রে নৌকায় একজনকে বলেছিলাম না, ইঞ্জিনিয়ার হব, সে কথা মনে পড়ছিল তখন!’ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে প্রথম হয়েছেন জুনাইদ। শিক্ষক ও বন্ধুদের সহযোগিতায় দারুণ আপ্লুত এখন তিনি। পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ নামে এক সংগঠন বৃত্তির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। তাঁর এখন একটাই স্বপ্ন, প্রকৌশলী হবেন। মমতা কিংবা টাকার অভাবে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করবেন। জুনাইদ বলছিলেন, ‘আপনারা তো ফোন পেলে বিরক্ত হন, কিন্তু আমাকে হঠাৎ কেউ ফোন করলে কী যে ভালো লাগে বোঝাতে পারব না! আমার কলেজের এক শিক্ষিকা মাঝেমধ্যে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, “রাতে কী খেয়েছ? ” তখন আমার চোখে পানি এসে যায়। আমার এখন স্থায়ী ঠিকানা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল। আমার জীবনে কষ্টের শেষ নেই, কিন্তু মানুষের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। মানুষের সব কষ্ট আমি দূর করতে চাই।’ জুনাইদের গল্পটা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়, তাই না?

SHARE THIS

Author:

Previous Post
Next Post